ইট-পাথরে গাথা শহুরে যান্ত্রিক
জীবন থেকে মুক্তি পেতে আর সোঁদা মাটির গন্ধের সন্ধানে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে
ঘুরতে বের হই। এবারের অভিযান সঙ্গী হিসেবে ছিল বন্ধুবর মাসুদ,অমি,নিপুন,নোমান,তানভীর,অদিতি
আর আনিকা । অভিযানের উত্তেজনায় দিগুণ মাত্রা যোগ করে প্রফেসর আকতার মাহমুদ স্যার
আর আফসানা ম্যামের উপস্থিতি। কাঁচের মত স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের গাঁ বেঁয়ে আছড়ে পড়ছে
বড় বড় পাথরের গায়ে। বুনোপাহাড়ের ১৫০ ফুট উপর হতে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দ
করে চারিপাশ গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতীর লাত পাতা ও লতা গুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ী
শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভুমিতে।
শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভুমিতে।
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের গহিন অরণ্যঘেরা দুর্গম পাহাড়ী এলাকার এই জলপ্রপাতটি অবস্থিত। স্থানীয় বাসিন্দারা একে হামহাম ঝর্না বা অনেকে হাম্মাম ঝর্না বলে ডাকে। এ জলপ্রপাতে যাবার কোনো রাস্তা না থাকলেও পর্যটকরা দূর্গম পাহাড় ও ছোট ছোট আকাবাকা এবং উচু উচু পাহাড় ডিংগিয়ে অনেক কষ্ট করে এখানে ছুটে যান প্রকৃতির নির্মল বিনোদন লাভের আশায়।
জীবনে বাঁশের যে কত প্রয়োজন পাহাড়ে ওঠা-নামা কিংবা পানির মধ্যে দিয়ে না গেলে বুঝতে পারতাম না |
আফসানা
ম্যামের নেতৃত্বে হামহামের উদ্দ্যেশে রওনা |
প্রকৃতির অপরূপ লীলাভুমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় নতুন সন্ধান পাওয়া রোমাঞ্চকর নয়নাভিরাম হামহাম জলপ্রপাত একনজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠছে দিনে দিনে। দীর্ঘ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথে অনেক কষ্টে গহীন অরন্যে এই জলপ্রপাতকে দেখতে প্রতিদিন আগমন ঘটছে দিনে দিনে পর্যটকদের ঢল।
প্রফেসর
ড.আকতার মাহমুদ স্যার, বয়স যার কাছে হার মেনেছে। আমাদের চেয়ে তিনিই বেশী উত্তেজিত ছিলেন
পুরোটা সময় জুড়ে। তাইতো সবার আগে হামহাম দেখা মাত্রই জুতো না খুলেই এক লাফ দিলেন
সাঁতারের জন্য। |
কোথাও
হাঁটু পানি, কোথাও বা কোমর । সাপ-জোকের অভাব নেই । তারপরও কেন জানি একটুও ভয় পাচ্ছিলোনা
কারো। |
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগের
অভাবে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক
(যদিও আমি ব্যাক্তিগত ভাবে
যোগাযোগের উন্নতি হোক সেটি চাইনা,কেননা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এমন কষ্টেই বেশী উপভোগ্য)। এছাড়া প্রচার
প্রচারনার অভাবেও বাংলাদেশের অন্যতম এই জলপ্রপাতটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত লোকচক্ষুর
অন্তরালে ছিলো।
দীর্ঘ
ক্লান্তির পরে পাঁচ মিনিটের বিরতি। প্রকৃতির এতো ভেতরে ঢুকে এমন সৌন্দর্য উপভোগ
সারা জীবন মনে রাখার মতোই । |
পথের দু পাশের বুনো গাছের সজ্জা
যে কোনো পর্যটকের দৃষ্টি ফেরাতে সক্ষম। জারুল, কৃষ্ণচূড়া,
বেত ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন
ডানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ
বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের
বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন এক রূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি
পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। দূর
থেকে কানে ভেসে আসবে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। ক্ষণেক্ষণে মনে হয় যেন আশেপাশের নয়নাভিরাম
পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই হাটতে হাটতে একসময় পৌঁছে যাবেন আপনার কাঙ্খিত
হামহাম জলপ্রপাতের খুব কাছাকাছি। কিছু দূর এগুলেই শুনতে পাবেন হামহাম জলপ্রপাতের
শব্দ।
চারিদিকে এক শীতল শান্ত পরিবেশ।
ডানে বামে চোখ ফেরানোর উপায় নেই। কেবলই ইচ্ছে করবে তাকিয়ে থাকি সৃষ্টিকর্তার এই
অনন্য সৃষ্টির জন্য। জঙ্গলে উল্লুক, বানর আর হাজার পাখির ডাকাডাকির সাথে
ঝর্নার ঝড়ে পড়ার শব্দ মিলে মিশে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। ক্ষনিকের
জন্য ভূলেই যেতে হবে কোথায় আছি, কিভাবে আছি। উপরে আকাশ, চারিদিকে বন, পায়ের নিচে ঝিরির স্বচ্ছ জল আর
সম্মুখে অপরূপ ঝর্না।
সেখানে কিছুক্ষন কাটানোর পর নিতে
হয় ফেরার প্রস্ত্তুতি। কারণ বেশীক্ষণ সেখানে অবস্থানের কারনে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে
পাহাড়ে ঘন কালো অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা শতভাগ। অপরদিকে বন্যপ্রাণীদেও আক্রমনেরও শিকার হতে পারে। ঢালু ও পিচ্ছিল
পাহাড়ী পথ বেয়ে উপওে ওঠা কষ্ট হলেও সহজ, কিন্তু পাহাড় হতে নিচে নেমে আসা খুবই
বিপজ্জনক ও কঠিন। কলাবনপাড়া হতে হামহাম জলপ্রপাতে যেতে-আসতে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময়
লেগে যায়।
ইতিহাস:
স্থানীয় পাহাড়ী অধিবাসীরা বলেন, পানি পতনের স্থানে এক সময় পরীরা
গোসল করত । গোসল খানাকে আরবীতে হাম্মাম বলে ও জলের স্রোতধ্বনীকে ত্রিপুরার টিপরা
ভাষায় হাম্মাম বলে তাই এ জলপ্রপাতটি হাম্মাম নামে পরিচিত। উপড়ে যে স্থান থেকে জল
পড়ে সেখান থেকে ২শত ফুট পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা সীমানা।
স্থানীয়দের
(গাইড) ভাষায় এ সাপটির নাম মাটালি । মারাত্মক বিষাক্ত এরকম একসাথে চারটি সাপকে তোয়াক্কা
না করে দুই ফুট পাশ দিয়ে আমাদের যেতে হয় । এখন সেটা মনে পড়লেই গা শিউরে ওঠে। |
হামহাম যাওয়ার জন্য বনের ভেতর
দুটি পথ আছে। বনের শুরুতেই হাতের ডানে ও বামে পাশাপাশি পথ দুটির অবস্থান। একটা
দিয়ে যেতে হবে আরেকটা দিয়ে আসবেন। ডানের পথ দিয়ে ঢুকে বাম দিয়ে বের হবেন এটাই ভালো, কারন ডানের পথটা দীর্ঘ এবং অনেক
গুলো উঁচু টিলা ডিংগাতে হয়, যা
ফেরার পথে পরলে খুব কষ্ট হবে, তাই প্রথমে কষ্ট করেন আসার সময় একটু আরাম করে আসবেন, ফেরার পথ কম না তবে সমতল বেশি, টিলা কম ডিংগাতে হয়।
হামহাম যাবার জন্য সাথে একজন গাইড
নিয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক। কারন প্রথমবার যারা যাবেন তাদের জন্য রাস্তা ভুল করাই
স্বাভাবিক। এছাড়া ভ্রমণের সময় পাহাড়ি পথে হাটার সুবিধার্থে এবং আত্মরক্ষার্থে
প্রত্যেকের সাথে একটি করে বাশ নেয়া আবশ্যক। এছাড়া জোকের হাত থেকে রক্ষা পেতে সাথে
করে লবণ ও সরিষার তেল নিয়ে নিলে ভালো হয়।
No comments:
Post a Comment