Saturday 20 February 2016

কাশ্মীর কথন - ২০১৬

রাত ১১ঃ৩০ এ বাস, অথচ বিকাল থেকে রাত আট পর্যন্ত ব্যাস্ত এই
 ব্যানার ডিজাইন আর প্রিন্ট করতে ... দুঃখের বিষয় পুরো
কাশ্মীর-আগ্রা ব্যানার সাথে নিয়ে ঘুরলেও ব্যানার সহ মাতর একটা ছবিই আছে...

আব্দুল্লাহ আল নোমান

১৪ই জানুয়ারি ২০১৬ রাত ১১;৩০, স্বর্গের ক্যাম্পাস খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে অপেক্ষা করছি বাসের জন্য। সাথে সঙ্গী হিসেবে আছে ভূস্বর্গ কাশ্মীর ট্যুরের ১৪ জন এবং সি অফ করতে আসা কয়েকজন জুনিয়র।ঢাকা থেকে বাসের সাথে আসছে জন। এবারের ট্যুরটা মূলত নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের (জাবি) ব্যাচ (আমরা এবং আমাদের সিনিয়র ব্যাচ) মিলে যৌথ ভাবে আয়োজন করছি। Duke of Edinburgh’s International Award Program এর Gold Level Adventurous Tour এর ব্যানারে আমাদের এবারের ট্যুর। সর্বমোট ১৮ জনের একটা গ্রুপ, যেখানে আমাদের ব্যাচের আমরা ১১ জন, আমাদের সিনিয়র ব্যাচের জন এবং একজন ম্যাডাম।
 বাসের জন্য অপেক্ষার সাথে সাথে মনের মধ্যে একটা চাঁপা উত্তেজনাও কাজ করছে। অবশেষে  ঘণ্টা দেরীতে বাস এসে পৌছলে আমাদের যাত্রা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হল। এরই মধ্যে ঘড়ির কাটা ১২ টা পেরিয়েছে। আড়াই ঘণ্টা যাত্রার পর পাটুরিয়া ফেরিঘাটে পৌছলাম। এর আগে ফেরিতে উঠার অভিজ্ঞতা আছে মোটে  বার। তবে এবারের ফেরিতে উঠাটা একটু অন্যরকম ভাবেই মনে থাকবে আমারকেননা ১৫ই জানুয়ারি আমার জন্মদিন১২ টা বাজার পর থেকেই সবার উইশ আর ছোটখাটো আয়োজনে এমনিতেই একটু চমকের উপরে আছিতবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় চমকটা ছিল ফেরিতে। কেননা ইতঃপূর্বে বন্ধুবান্ধবের সাথে জন্মদিনের কেক কাটার অভিজ্ঞতা থাকলেও ফেরিতে ভরা মজলিসে শত শত মানুষের সামনে কেক কাটা এবারই প্রথম১৪ জানুয়ারি মাসুদের জন্মদিন থাকায় কেকটা দুজনে সম্মিলিত ভাবেই কাটলাম 

দীর্ঘ ঘণ্টার বাস জার্নি শেষে বেনাপোল বন্দরে পৌছলাম সকাল :৩০ মিনিটে এর আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন ইমিগ্রেশনের কোন ঝামেলাই পোহাতে হয়নি, কিন্তু এইবার দুই বর্ডারেই ভাল ঝামেলা পোহাতে হল, বন্ধু কাউসারের পাসপোর্টে পাসপোর্ট অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টরের সিল থাকলেও সাইন না থাকায় বেশ হ্যাপা পোহাতে হয়, অনেক দেন দরবারের পর তার পাসপোর্ট ফেরত পাওয়া যায়। অতঃপর দ্বিতীয় দফায় ঝামেলা পোহাতে হয় ইন্ডিয়ান কাস্টমসে, সবার কাছে পর্যাপ্ত ডলার না থাকার অজুহাতে তারা আমাদেরকে অনেক জ্ঞানগর্ভ বয়ান শোনায়, ইন্ডিয়ান কারেন্সি নিয়ে বর্ডার অতিক্রম করা বেআইনি, এই আইনের আওতায় আমার কাছে থাকা ৭২০ রুপি হস্তগত করে অবশেষে সেখান থেকে পার পাওয়া যায়। আফসানা ম্যামেম ভাষ্যমতে আমার জন্মদিনে তাদেরকে নাকি আমি ৭২০ রুপির ট্রিট দিয়ে এসেছি  দুই বর্ডারের ইমিগ্রেশন পর্ব শেষে হালকা কিছু নাস্তা করে আবারও বাসে উঠে পরলাম ১২ টার দিকে, এবারের যাত্রা পেট্রোপোল থেকে কোলকাতা। দূরত্বটা যদিও ৮০ কি মি একটু বেশি কিন্তু যানজট আর সরু রাস্তার কারণে কোলকাতা পৌছতে পৌছতে প্রায় টা বেজে গেলো। 
হাওড়া স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা... 
কোলকাতায় বাংলাদেশি বাস কাউন্টার গুলোর পাশেই প্রচুর হোটেল পাওয়া যায়।এই এলাকাটা মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ এখানেই হোটেল ভাড়া নেয়। সর্বনিম্ন হাজার রুপি থেকে রুম ভাড়া শুরু, তবে নিউমার্কেট থেকে একটু দূরে থাকলে ৪০০-৫০০ রুপিতেও থাকা সম্ভব। বাস কাউন্টার থেকে হাটা দুরত্তে হোটেল প্যারাডাইজ ছিল আমাদের গন্তব্য। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে বের হলাম কোলকাতা ঘুরতে। কোলকাতায় গিয়ে সর্বপ্রথম কাজ হল রুপি করা, বাস কাউন্টারের আশপাশেই / টা মানি এক্সচেঞ্জার আছে, এখান থেকেই ভাল দাম পাওয়া যায় সাধারণত। প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা শেষে টার মধ্যেই হোটেলে ফিরলাম কেননা খানিক বাদেই হোটেল ছেড়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। হোটেল থেকে ব্যাগ গুছিয়ে ১০ টার মধ্যে ট্যাক্সি ধরলাম হাওড়া স্টেশনের জন্য, হোটেল থেকে ট্যাক্সি করে ৩০ মিনিটের যাত্রা পথ হাওড়া ষ্টেশন। হাওড়া ষ্টেশন থেকে হিমগিরি এক্সপ্রেসে চড়ে জম্মুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল রাত ১১;৩০ মিনিটে। প্রায় ২০১৪ কিমির যাত্রা পথ, শিডিউল মতে ৩৬ ঘণ্টার যাত্রা শুরু 

১৫ই জানুয়ারি রাত ১১;৩০ মিনিটের হিমগিরি এক্সপ্রেস ৩০ মিনিট বিলম্বে হাওড়া স্টেশন থেকে জম্মুর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। শিডিউল মতে ৩৬ ঘণ্টা পর জম্মু তিওয়াই ষ্টেশনে পৌঁছানোর কথা। ইন্ডিয়া ট্যুরের অন্যতম ইন্টারেস্টিং পার্টটুকু আমার কাছে হল ট্রেন জার্নি, কেননা আমাদের দেশে আমরা সাধারণত ১২ ঘণ্টার বেশি ট্রেন জার্নিতে অভ্যস্ত না, কিন্তু ইন্ডিয়ার এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশের ট্রেন জার্নিগুলো নরমালি ৩০-৪০ ঘণ্টার হয়ে থাকে। ইন্ডিয়াতে সাধারণত এক প্রদেশের বাস অন্য প্রদেশে যেতে পারেনা, যেতে চাইলে বড় অঙ্কের ট্যাক্স গুণতে হয়। একারণে ইন্ডিয়ার মানুষ বাস জার্নিতে খুব একটা অভ্যস্ত নয় আমাদের মতো। 
এখানকার ট্রেন জার্নিটা আমার কাছে একটা চলমান সংসারের মতো। কেননা ৩০-৪০ ঘণ্টা যখন আপনাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করতে হয় তখন আপনাকে কিছুটা হলেও সাংসারিক পসরা সাজিয়ে বসতে হবে সেখানে। সেটা সকালের ব্রাশ-পেস্ট থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোতে যাবার কাঁথা বালিশ পর্যন্ত বিস্তৃত। 
১৫ তারিখ রাতে কোলকাতা থেকে ট্রেন জার্নি শুরু করে মাঝরাত থেকেই ঠাণ্ডার প্রকোপ টের পেতে শুরু করি। শীতের কাপড় পরে, মাথায় কান টুপি পায়ে মোজা, আর কম্বল পেচিয়েও রাতে ঠাণ্ডার হাতে বেশ কয়েকবার নাকাল হতে হয়েছে। প্রতিবার ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠার পর চিন্তা করেছি এখানেই এই অবস্থা না জানি কাশ্মীরে কী অবস্থা হয়! ১৬ তারিখ সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি রাতে নাকি জেমি আপু ট্রেন থামানোর চেষ্টা করেছিলেন! কারণ তার ধারণা এই ঠাণ্ডাই যদি সহ্য করতে কষ্ট হয় তাহলে কাশ্মীরের ঠাণ্ডা সহ্য করা সম্ভবই না, একারণে উনি ট্রেন থামিয়ে কোলকাতা ব্যাক করতে চেয়েছেন(যদিও এই মানুষই পরবর্তীতে পেহেলগামের মতো জায়গায় মাইনাস তাপমাত্রায় শাড়ি পরে শীতকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন সারাদিন শুয়ে বসে আড্ডা দিয়ে দিন পার করতে লাগলাম। বছরের ক্যাম্পাস লাইফে যেখানে আমি কার্ড খেলা শিখতে পারিনি সেখানে মাত্র একদিনের ট্রেন জার্নিতেই আমার কার্ড খেলা শেখা হয়ে গেছে কখনওবা কার্ড খেলে, অথবা সবাই মিলে গানের কলি খেলে, আশপাশের যাত্রীদের সাথে তুমুল আড্ডা জমিয়ে ট্রেন জার্নিটা ভালই কাটছিল। ইন্ডিয়ার ট্রেন জার্নি আমার কাছে সবসময়ই উপভোগ্য। কেননা ট্রেনের যাত্রীরা খুবই আন্তরিক হয়। যেকোনো প্রয়োজনেই তারা আপনাকে তাদের সাধ্যমত সাহায্য করার চেষ্টা করবে। যেতে যেতেই এক পাঞ্জাবী এবং এক কলকাতার দাদার সাথে আমাদের সেই খাতির জমে যায়। তবে ইন্ডিয়ান ট্রেনের সবচেয়ে বিভীষিকার নাম হচ্ছে ট্রেনের খাবার আর হিজড়া! ট্রেনের খাবার তাও কোনরকমে গলধঃকরন করা যায়, কিন্তু হিজড়ার অত্যাচারে মাঝেমধ্যে মান সম্মান রক্ষা করা একটু কষ্টকর হয়ে যায়  এসব কারণে ইন্ডিয়ান ট্রেনে কখনও বিনোদনের অভাব হয়না 

কাশ্মীর ট্যুরের কথা মনে পড়লে সবার আগে চলে আসে ট্রেনের কথা।   
সারাদিনের আড্ডা শেষে রাতের খাবারের পর সবাই ঘুমের দেশে, হঠাৎই স্বর্ণার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। জেগে দেখি হাত মোজা পা মোজা পরার পরও তার হাত পা সব ঠাণ্ডায় জমে বরফ হওয়ার অবস্থায়! হাত পায়ে তেল মাখার পর অবস্থা কিছুটা ভাল হলে আবার একটু ঘুমোতেই কান্নার শব্দে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে! এই রাত বিরাতে কান্নাকাটি! উঠে দেখি উপরের সিটে থাকা ঈশিতা ঠাণ্ডায় বাচ্চা মানুষের মতো কান্নাকাটি শুরু করেছে! জম্মু গিয়ে কম্বল কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অবশেষে তার কান্নার অবসান! সবকিছুর পর শেষরাতে গিয়ে আরামের ঘুম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে আস্তে আস্তে ভ্রাম্যমাণ সংসার গোছাতে শুরু করে সবাই। কেননা দুপুর ১২ টা নাগাদ আমাদের জম্মু ষ্টেশনে পৌঁছানোর কথা। তবে মাঝে পাঞ্জাব ষ্টেশনে আসার পর বুঝতে পারলাম আমাদের ট্রেন প্রায় ঘণ্টা লেট। যার ফলে ১২ টার বদলে টা নাগাদ আমরা জম্মু তিওয়াই ষ্টেশনে পৌছি। 
গত দুইদিনের ট্রেনের অভিজ্ঞতা থেকেই পর্যাপ্ত শীতের কাপড় গায়ে চাপিয়েই কাশ্মীর প্রদেশের শীতকালীন রাজধানী জম্মুতে পদার্পণ করি আমরা। কিন্তু ভরদুপুরে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়াতেও এখানে ১০-১২ ডিগ্রি তাপমাত্রা! স্টেশন থেকে মিনি বাসে করে . কিমি দুরত্তে থাকা আমাদের হোটেলে পৌছতে সময় লাগে প্রায় ২০ মিনিট।হোটেলের নাম আশোকা নিউ ডায়মন্ড। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে বের হলাম জম্মু শহর দেখতে। ঘোরার জায়গা বলতে কাছেই বাস স্ট্যান্ড এর পাশে পাহারের কোলে এখানকার বড় একটা মল বা মার্কেট, বস্তুত রাস্তার দুপাশ ঘিরে পুরো এলাকা জুড়েই মার্কেটের বিস্তৃতি।পর্যটকের চেয়ে লোকাল মানুষের ভিড়ই এখানে বেশী। সবাই মিলে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে চা খেয়ে পাশের এক দোকান থেকে টেলিফোনে বাংলাদেশে যোগাযোগ সেরে মার্কেটে গেলাম। রাত টায় এখানকার সব মার্কেট বন্ধ হয়ে যায়, এই সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে হোটেলের পথ ধরলাম। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর্ব সেরে একটু তাড়াতাড়ি শোবার প্রস্তুতি, কেননা রাতে তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি নেমে যাবে আর ভোর টায় এখান থেকে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে। মূলত শ্রীনগর থেকেই কাশ্মীরের আসল সৌন্দর্যের শুরু

বাস্তবিক অর্থে জম্মু শহরটা কাশ্মীরের অন্যান্য জায়গার মতো অতোটা জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান নয়। কেননা যারা বাই এয়ারে কাশ্মীরে যায় তারা সরাসরি শ্রীনগরে যায়, আর যারা বাই রোডে কাশ্মীর যায় তারা জম্মুকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। এজন্য জম্মুতে পর্যটকের সংখ্যাটা তুলনামুলকভাবে একটু কম। তবে কেনাকাটার জন্য কাশ্মীরের অন্যান্য জায়গার চেয়ে জম্মু অনেক সাশ্রয়ী। পর্যটকদের জন্য কাশ্মীরে সিম কেনার বিষয়ে অনেক বিধিনিষেধ আছে, আর পোস্টপেইড ব্যতিত অন্য প্রদেশের কোন সিম এখানে কার্যকর না। যার ফলে এখানকার লোকাল সিম পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়। যোগাযোগের জন্য গাড়ির ড্রাইভার বা হোটেলের ফোনই একমাত্র ভরসা।

শ্রীনগর হল কাশ্মীর প্রদেশের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং কাশ্মীরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন দুটি রাজধানী হওয়ায় কাশ্মীরে এই দুই মৌসুমের শুরুতে - দিনব্যাপী বাই রোডে সমস্ত অফিসিয়াল দলিল দস্তাবেজ সহ রাজধানী পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। শ্রীনগর সহ কাশ্মীরের বেশীরভাগ দর্শনীয় স্থানগুলি আপনি চাইলে শ্রীনগরে থেকেই ঘুরে আসতে পারেন।একারণে কাশ্মীর ট্যুরের ক্ষেত্রে শ্রীনগর শহর পর্যটকদের কাছে সেন্টার পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

১৮ তারিখ সকাল টায় জম্মু থেকে শ্রীনগরে যাত্রার কথা থাকলেও বাস আসতে দেরি হওয়ায় আমাদের যাত্রা শুরু হয় ;৩০ মিনিটে।জম্মু থেকে শ্রীনগরের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিমি।পাহাড়ি রাস্তা হওয়ায় যেতে কমপক্ষে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে গাড়িতে। বাই রোডে যাওয়ার মাধ্যম হচ্ছে টাটা সুমো, কার বা ওখানকার লোকাল ২২/২৭ সিটের মিনি বাস। জানালায় baby doll আর apple এর লোগো সমৃদ্ধ আমাদের ২২ সিটের মিনি বাসটা ছিল আমাদের দেশের ছোট ম্যাক্সি টাইপের বা সৌরভ ভাইয়ের ভাষায় বিস্কুট  এর আগে হিমাচল প্রদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা থাকায় খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে এরকম জায়গায় গাড়িতে করে যাওয়ার সময়কার চারপাশের দৃশ্যাবলী কোনভাবেই কোন দর্শনীয় স্থানের চেয়ে কম সুন্দর নয়, অনেক সময় অনেকটা বেশিও। এসব রাস্তায় চলাচলের কিছু কমন দৃশ্য হচ্ছে কিছুদূর পর পরই ধাবা বা খাবারের দোকান পাওয়া যায় এবং কয়েক ঘণ্টা পরপরই ড্রাইভাররা এসব ধাবায় গাড়ি থামায়। এখানে আপনি চাইলে হালকা নাস্তা করে ফ্রেশ হয়ে নিতে পারবেন। ঘণ্টা খানেক যাওয়ার পর এরকম এক ধাবায় আমাদের যাত্রা বিরতি হল। সকালের নাস্তা হোটেলেই সেরে আসায় এখানে সবাই চা আর হালকা কিছু ড্রাই ফুড নিয়ে নিলো। এসব জায়গার চা টা অনেক মজার, আর এরকম ঠাণ্ডা জায়গার আরেকটা মজার বা সুস্বাদু খাবার হচ্ছে জাফরান মিশ্রিত গরম দুধ। নাস্তা পর্ব শেষে গাড়ির কাছে যেতেই শুনি গাড়ির কি যেন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে গাড়ি গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিছুটা রাস্তা হেঁটে আমাদেরকে সেই গ্যারেজে পৌছতে হবে। প্রায় দেড় কিলো পাহাড়ি হাইওয়ে রাস্তা হেঁটে গিয়ে গ্যারেজে পৌঁছানোটা ছিল এই ট্যুরের অন্যতম রোমাঞ্চকর একটা মুহূর্ত। রাস্তার একপাশে কয়েকশো ফিট উঁচু খাড়া পাহাড়, আর অন্য পাশে কয়েকশো ফিট নিচু খাড়া পাহাড়ি ঢাল। আর রাস্তায় কিছুক্ষন পরপরই আর্মির বড় বড় ট্রাকের আনাগোনা, সাথে আমাদের সবার সেলফি উৎসব। গ্যারেজে পৌঁছানোর প্রায় ঘণ্টা পর গাড়ি ঠিক হবার পর আবারও আমাদের যাত্রা শুরু।এরকম পাহাড়ি রাস্তা আপনাকে কখনই সৌন্দর্যের কোন প্রকার কমতি দিবেনা, কেননা প্রকৃতি এখানে মন প্রাণ উজাড় করে তার সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে রেখেছে। চলতি পথে যতটা রাস্তা আপনি ঘুমিয়ে কাটাবেন ঠিক ততোটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই আপনি উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত থাকবেন। যারা উচ্চতা ভীতিগ্রস্ত তাদের জন্য এরকম জার্নি একটু বেশীমাত্রারই ভয়ংকর কেননা পাহারের কোল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা এই সর্পিলাকার রাস্তা কিছু জায়গায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফিট উপরে উঠে যায়। তবে এই ভয়কে ভয় না পেয়ে এঞ্জয় করাই শ্রেয় দুটো গাড়ি কোনরকমে পাশাপাশি চলতে পারবে এরকম জায়গাতেও এখানকার ড্রাইভাররা দিব্যি ওভারটেক করে চলেছে। রাস্তার পাশে বেশীরভাগ জায়গাতেই সীমানা প্রাচীর বলতে কিচ্ছু নেই, গাড়ির জানালা দিয়ে তাকালে কিছু জায়গায় হয়তো হাজারখানেক ফিট নিচে মাটি অথবা হ্রদের দেখা মিলছে কিছু জায়গায় সেটাও না। পথিমধ্যে কিছু ছোটখাটো টানেল পার হয়ে আমরা প্রবেশ করলাম প্রায় কিমি দীর্ঘ জহর টানেলে। পাহারের বুক চিড়ে তৈরি করা এই টানেলে কেমন যেন একটা গাঁ ছমছমে পরিবেশ। ইন্ডিয়ার ৩য় দীর্ঘতম টানেল এটি, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২২০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। 

বলে রাখা ভাল, এসব জায়গায় গাড়ির ড্রাইভারদের মর্জি মাফিক চলাই ভাল, কেননা একবার তারা বিগড়ে গেলে তাদেরকে বশে আনা খুবই কষ্টসাধ্য বিষয়। এরকম ছোট্ট একটা ভুলের কারণে আমাদেরকে সেদিনকার লাঞ্চ করতে হয়েছিল দুপুরের বদলে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে! ঘটনা হল এখানকার ধাবাগুলোর সাথে ড্রাইভারদের এক ধরণের চুক্তি থাকে, চুক্তি অনুযায়ী তারা সেসব ধাবাতেই গাড়ি পার্ক করে এবং সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে। সেরকম একটা ধাবায় আমরা নামতে না চাওয়ায় ড্রাইভার আমাদেরকে আর কোথাও খাবারের জন্য থামায়নি। পরবর্তীতে কিছুটা অনুরোধের জোরেই সন্ধ্যার আগ দিয়ে সে আমাদেরকে লাঞ্চের ব্যবস্থা করায়।খাবারের পর রাস্তায় এসে দাড়িয়ে দেখি দূরে পাহারের চুড়ায় সাদা বরফের আস্তরণ আমাদেরকে হাতছানি দিচ্ছে। গধুলির রাঙ্গা আলোয় দূর পাহাড়ের চুড়া তখন সত্যিকার অর্থেই এক অনন্য সৌন্দর্যের ভাণ্ডার খুলে বসেছে। সন্ধ্যার আলো আধারিতে পাহাড়ি রাস্তায় এগিয়ে চলছে আমাদের বেবি ডল গাড়ি। হঠাৎই একটা টানেল অতিক্রম করে বের হয়ে আসতেই সকলেই একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠি, কেননা রাস্তার পাশেই বরফে আচ্ছাদিত সাদা পাহাড়। জীবনে প্রথমবারের মতো এতোটা কাছ থেকে বরফ দেখার উত্তেজনায় সবাই রোমাঞ্চিত। এই রোমাঞ্চকে সাথে নিয়েই আমরা আমদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চললাম। 
রাত প্রায় ১০ টার দিকে অনেক অলিগলি পেড়িয়ে অবশেষে আমাদের হোটেলের দেখা পেলাম, হোটেল গ্র্যান্ড তাবিয়া। গাড়ি থেকে নামতেই কাশ্মীরি ঠাণ্ডা যেন আমাদের সবাইকেই জেঁকে ধরল। - টা করে সোয়েটার পরার পরও গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের রিসিপশন অব্দি যেতেই আমরা ঠাণ্ডায় কাবু!!!! অথচ তাপমাত্রা তখনও মাইনাসের অনেক উপরে, / ডিগ্রি। হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হওয়া বাদ দিয়ে সবাই করিডরে দাড়িয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলো হোটেলের wifi কানেক্ট করতে। কেননা কাশ্মীর আসার পর এই প্রথম নিজের মোবাইল থেকে বাসায় যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা পাওয়া গেলো। ঘণ্টা খানেক বাদে সবাই ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে ঘুমানোর আয়োজনে ব্যস্ত। কেননা এর আগে কখনও মাইনাস ডিগ্রি টেম্পারেচারে থাকার অভিজ্ঞতা কারও নেই। ইনার জিনিসটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এদিন হাড়েহাড়ে টের পেয়েছি। ইলেকট্রিক ব্লাঙ্কেটের ব্যবস্থা থাকায় অনেকেই এই জিনিসের দ্বারস্থ হল। তবে আমি এই জিনিস ছাড়াই রাত কাটানোর সাহসী পদক্ষেপ নিলাম। তবে পদক্ষেপটা খুব একটা সহজ ছিলোনা। হাতে পায়ে মোজা পরে, মাথায় কান টুপি, গায়ে হুডি আর ইনারের উপর আরেকটা ট্রাউজার পরে তবেই একজোড়া কম্বলের নিচে আশ্রয় নিলাম ঘুমুতে যাওয়ার আগে একটাই চাওয়া ছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠে যেন গিজারে গরম পানি পাওয়া যায়, কেননা এখানকার ঠাণ্ডায় গিজারের পানি গরম হতেও খবর হয়ে যায়! ট্যুরের সূচী অনুযায়ী পরদিন শ্রীনগরের লোকাল সাইটগুলো ঘুরতে যাওয়ার মাধ্যমে শ্রীনগর দর্শন শুরু হবে।

No comments:

Post a Comment